হালুম্মা —১৮
হালুম্মা ইলা'উলূমিল হাদীস —১৮
সহীহ হাদীস ও গায়রে সহীহ হাদীস দ্বারা কী উদ্দেশ্য? বা
ওলামাদের কওল: ‘এই হাদীসটি সহীহ নয়’ —এর উদ্দেশ্য কী —১
📗 ইমাম নববী রহ.
ইমাম নববী রহ. তাঁর ইরশাদু তুল্লাবিল হাক্বাইক-এ বলেন—
إذا قيل في حديث إنه صحيح فمعناه ما ذكرنا، ولا يلزم أن يكون مقطوعا به في نفس الأمر وكذلك, وإذا قيل: إنه غير صحيح، فمعناه لم يصح إسناده على هذا الوجه المُعتبر، لا أنه كذب في نفس الأمر
যখন বলা হবে, হাদীসটি সহীহ; এর অর্থ হচ্ছে (সহীহের যে শর্তগুলো) উল্লেখ করা হয়েছে (হাদীসটির মধ্যে সেই শর্তগুলো বিদ্যমান রয়েছে)। এটা আবশ্যক নয় যে হাদীসটি বাস্তবেই অকাট্য সহীহ হবে। একইভাবে যখন বলা হবে, হাদীসটি গায়রে সহীহ; এর অর্থ হচ্ছে, হাদিসটির সনদ হয়তো সহীহ নয়, কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, হাদীসটি বাস্তবিকপক্ষেই মিথ্যা। [ইরশাদু তুল্লাবিল হাকাইক: ১/১১১]
অর্থাৎ হাদীসটি সনদের দিক থেকে হয়তো সহীহ; বাস্তবিকপক্ষে সহীহ নাও হতে পারে। আবার হাদীসটি সনদ-বিচারে হয়তো য'ঈফ, কিন্তু বাস্তবে হাদীসটি সহীহও হতে পারে।
📗 ইমাম ইবনুস সালাহ রহ.
ইমাম ইবনুস সালাহ তাঁর ‘মুকাদ্দিমা’য় বলেন—
إذا قالُوا: «هَذا حَدِيثٌ صَحِيحٌ» فَمَعْناهُ: أنَّهُ اتَّصَلَ سَنَدُهُ مَعَ سائِرِ الأوْصافِ المَذْكُورَةِ، ولَيْسَ مِن شَرْطِهِ أنْ يَكُونَ مَقْطُوعًا بِهِ فِي نَفْسِ الأمْرِ، إذْ مِنهُ ما يَنْفَرِدُ بِرِوايَتِهِ عَدْلٌ واحِدٌ، ولَيْسَ مِنَ الأخْبارِ الَّتِي أجْمَعَتِ الأُمَّةُ عَلى تَلَقِّيها بِالقَبُولِ. وكذلك إذا قالوا فِي حَدِيثٍ: «إنَّهُ غَيْرُ صَحِيحٍ» فَلَيْسَ ذَلِكَ قَطْعًا بِأنَّهُ كَذِبٌ فِي نَفْسِ الأمْرِ، إذْ قَدْ يَكُونُ صِدْقًا فِي نَفْسِ الأمْرِ، وإنَّما المُرادُ بِهِ أنَّهُ لَمْ يَصِحَّ إسْنادُهُ عَلى الشَّرْطِ المَذْكُورِ، واللَّهُ أعْلَمُ.
যখন মুহাদ্দিসগণ বলেন, হাদীসটি সহীহ। এর অর্থ হচ্ছে, হাদিসটির সনদ (সহীহের) উল্লেখিত সমস্ত শর্তে উত্তীর্ণ হয়েছে। তবে সহীহ হওয়ার জন্য এমন কোন শর্ত নেই যে হাদীসটি বাস্তবিকপক্ষেই অকাট্যভাবে সহীহ হতে হবে। (অর্থাৎ বাস্তবিকপক্ষে সহীহ না হলেও পারিভাষিকভাবে হাদীসটি সহীহ)। কারণ, কখনো রেওয়ায়েতের ক্ষেত্রে একজন আদিল রাবী মুনফারিদ (একাকী) হন এবং খবরটি এমনও নয় যে উম্মত সেটিকে সর্বসম্মতভাবে গ্রহণ করে নিয়েছে। একইভাবে, যখন বলা হয়, হাদীসটি গায়রে সহীহ; (এর দ্বারা কখনোই এটা উদ্দেশ্য) নয় যে, হাদীসটি বাস্তবিকপক্ষেই চূড়ান্তভাবে মিথ্যা। কারণ, কখনো তা (পারিভাষিকভাবে ‘গায়রে সহীহ’ হাদীসও) বাস্তবিকপক্ষে সহীহ হতে পারে। আর ‘গায়রে সহীহ’ বলার দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, হাদীসটির সনদ উল্লেখিত শর্তে সহীহ নয়। [মুকাদ্দিমাতু ইবনিস সালাহ: ৯]
📗 হাফিয জালালুদ্দীন সুয়ূতী রহ.
হাফিয সুয়ূতী রহ. ইমাম নববীর বক্তব্যের ব্যাখ্যায় বলেন,
" ( وإذا قيل ) هذا حديث ( غير صحيح ) : فمعناه لم يصح إسناده على الشرط المذكور ، لا أنه كذب في نفس الأمر ، لجواز صدق الكاذب ، وإصابة مَن هو كثير الخطأ... (وإذا قِيلَ) هَذا حَدِيثٌ (صَحِيحٌ فَهَذا مَعْناهُ) أيْ: ما اتَّصَلَ سَنَدُهُ مَعَ الأوْصافِ المَذْكُورَةِ، فَقَبِلْناهُ عَمَلًا بِظاهِرِ الإسْنادِ (لا أنَّهُ مَقْطُوعٌ بِهِ) فِي نَفْسِ الأمْرِ، لِجَوازِ الخَطَأِ والنِّسْيانِ عَلى الثِّقَةِ
যখন বলা হয় হাদীসটি গায়রে সহীহ, এর অর্থ হচ্ছে হাদীসটির সনদ (সহীহের আলোচনায়) উল্লেখিত শর্তে সহীহ নয়। সনদ সহীহ না হওয়ার মানে এই নয় যে, হাদীসটি বাস্তবেই মিথ্যা। কারণ, মিথ্যুকও সত্য বলে থাকে এবং অধিক ভুলকারীও সঠিক হয়ে থাকে...। আর যখন বলা হয় হাদীসটি সহীহ; এর অর্থ হচ্ছে, হাদিসের সনদ (সহীহের আলোচনায়) উল্লেখিত শর্তে উত্তীর্ণ। অতএব, আমরা সনদের দিক থেকে সেটি গ্রহণ করে থাকি। তবে বাস্তবিকপক্ষে হাদীসটি অকাট্যভাবে সহীহ নয়, কারণ বিশ্বস্ত ল
রাবীদের থেকেও ভুল হতে পারে। [তাদরীবুর রাবী: ১/৭৫-৭৬]
অর্থাৎ, কোনো হাদীসকে ‘সহীহ নয়’ বলার দ্বারাই হাদীসটি চূড়ান্তভাবে মিথ্যা হয়ে যায় না। কারণ, কখনো কখনো য'ঈফ হাদীসও বাস্তবে সহীহ হতে পারে। আর ‘সহীহ নয়’ বলার দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, হাদীসটি সহীহের উল্লেখিত শর্তে হয়তো সহীহ নয়; তবে আদতে হাদীসটি সহীহ হতে পারে। কোন হাদিসটি সহীহ আর কোন হাদিসটি সহীহ নয় এ ব্যাপারে ইমামগণ সিদ্ধান্ত দেবেন।
ইমামগণ ‘সহীহ’ সিদ্ধান্ত দেওয়ার পরে হাদীসটি সনদ বিচারে য'ঈফ হাওয়াতে কিছু যায় আসে না। কারণ, একটা হাদীসের ক্ষেত্রে সনদই সবকিছু নয়; বরং সনদ হচ্ছে, হাদীস যাচাইয়ের একটি মাধ্যম মাত্র।
বর্তমানে, হাদীস শাস্ত্রের সাথে সম্পর্ক নেই —এমন অনেকে সনদকেই সবকিছু মনে করে, অথচ তা সম্পূর্ণ ভুল। বিষয়টি হাদিস শাস্ত্রের সাথে সংশ্লিষ্টরা ভালোই বুঝবেন।
তাই তো দেখা যায়, অনেক ক্ষেত্রে ইমামগণ বলে থাকেন, اسناده ضعيف (হাদীসটির সনদ দুর্বল)। আবার কোথাও বলে থাকেন, حديث ضعيف (হাদিসটি দুর্বল)। তো দুই রকমের কথা (হাদীসটির সনদ দুর্বল ও হাদীসটি দুর্বল) এর মানে কী?
মূলত হাদিসটির সনদ দুর্বল বলতে কেবল সনদকেই দুর্বল বোঝায়; মূল হাদীসটি দুর্বল নয়। বরং বিভিন্ন ‘শাওয়াহেদ’ ও ‘তাওয়াবি’ এর কারণে দুর্বল সনদের হাদীসটি সহীহও হতে পারে। যেমন আলোচ্য হাদীসটি।
যদি সনদই মূল হতো, তাহলে সনদ সহীহ হওয়ার পরেও হাদীস কখনো য'ঈফ হতো না। অথচ হাদীসের কিতাবগুলোতে এমন বহু হাদীস আছে যেগুলো সনদ বিচারে তো সহীহ অথচ বাস্তবে তা য'ঈফ।
অতএব, যারা ইমামগণের ‘সহীহ’ সিদ্ধান্ত দেওয়ার পরেও কোনো হাদীসকে কেবল সনদ বিচারে য'ঈফ হওয়ার কারণে য'ঈফ/অগ্রহণযোগ্য বলে; তারা কি বোঝাতে চায় যে হাদীসের ইমামগণ হাদীসটির সনদ সম্পর্কে জানতেন না?
আমরা বলো, অবশ্যই জানতেন। হাদীসের ইমাম হাদীসের সনদ সম্পর্কে জানবেন না এটা অসম্ভব। তো হাদীসের সনদ য'ঈফ জেনেও ইমামগণ যখন একটি হাদীসকে সহীহ বলে, এর অর্থ হচ্ছে এই হাদীসের ক্ষেত্রে সনদ মুখ্য নয়, তথা হাদীসটি সহীহ হওয়ার ক্ষেত্রে সনদের মুখাপেক্ষী নয়। বিভিন্ন দলিলাদি ও বিভিন্ন ‘শাওয়াহেদ’ ও ‘তাওয়াবি’ এর কারণে হাদীসটি সহীহ বলে প্রমাণিত।
[অপ্রাসঙ্গিক]
অবশেষে, বিরুদ্ধবাদীদের প্রতি আমাদের প্রশ্ন থাকলো, হাদীসের সনদ য'ঈফ জেনেও ইমামগণ (বিশেষ করে কট্টরপন্থী আলবানী) কেন হাদীসটিকে সহীহ সাব্যস্ত করেছেন, যদি হাদীসটি বাস্তবেই সহীহ না হতো! নাকি তারা খিয়ানত করেছেন।
এ কারণেই তো ইমামগণ বলে গেছেন, যে সনদ সহীহ হলেই হাদীসটি চূড়ান্ত সহীহ হয়ে যায় না, আবার সনদ দুর্বল হলেই হাদীসটি চূড়ান্ত মিথ্যা হয়ে যায় না; বরং এর বিপরীতও ঘটে থাকে।
লুবাব হাসান সাফওয়ান
কোন মন্তব্য নেই