হালুম্মা ইলা 'উলূমিল হাদীস —১৭ [খ]
হালুম্মা ইলা 'উলুমিল হাদীস —১৭
তাদলীস ও মুদাল্লিস রাবী সংক্রান্ত আলোচনা —৩
[মুদাল্লিস রাবীর বর্ণনা মুতলাকান (সর্বাবস্থায়) অগ্রহণযোগ্য—গত দুই পর্বে আমরা এ বিষয়ে আলোচনা করেছিলাম। আজকের আলোচনা এর বিপরীত।]
📗 ইমাম নববীর উসূল। ইমাম নববী বলেন-
وما كانَ فِي الصَّحِيحَيْنِ وشِبْهِهِما مِنَ الكُتُبِ الصَّحِيحَةِ، عَنِ المُدَلِّسِينَ بِعَنْ، فَمَحْمُولٌ عَلى ثُبُوتِ السَّماعِ لَهُ مِن جِهَةٍ أُخْرى
সহীহায়ন ও এ দুটোর মতো অন্যান্য সহীহ হাদীসের কিতাবসমূহের মধ্যে মুদাল্লিস রাবীদের যে সমস্ত ‘আন’যুক্ত হাদীস রয়েছে, এগুলোর ক্ষেত্রে ভিন্ন সনদে শোনার স্বীকৃতি রয়েছে। [তাদরীবুর দাবী —সুয়ূতী: ১/২৬৪]
অর্থাৎ মুদাল্লিস রাবীর ‘আন’যুক্ত হাদীস গ্রহণযোগ্য নয় এই উসুলটি বুখারী-মুসলিম ও সুনানে নাসা'ঈ এবং এই পর্যায়ের অন্যান্য সহীহ হাদীসের কিতাব সমূহের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।
📗 উসুল: মুুদাল্লিস রাবী ইমাম শু'বাহ’র হাদিস সংক্রান্ত উসূল
ইমাম শু'বাহ যদি কোনো মুদাল্লিস রাবী থেকে বিশেষ করে কাতাদা থেকে বর্ণনা করে তবে সর্বাবস্থায় তা সহীহ বলে বিবেচিত, এমনকি মুআনআন হলেও। আসুন উসুলটি পড়ে নিই-
وقال شعبة كفيتكم تدليس ثلاثة: قتادة، وأبي إسحاق، والأعمش. فإن وجدنا قتادة يروي عنه شعبة فلا ننظر في عنعنته سواء في الصحيحين أو في غير الصحيحين.
আমিরুল মু'মিনীন ফিল হাদিস ইমাম শু'বাহ বলেন- আমি তোমাদের জন্য তিন ব্যক্তির তাদলীস যথেষ্ট (গ্রহণযোগ্য) মনে করি, কাতাদাহ, আবু ইসহাক ও আ'মাশ। (লেখক বলেন) অতএব আমরা যখন ইমাম শু'বাহকে কাতাদাহ থেকে বর্ণনা করতে দেখি তখন আমরা কাতাদাহ’র আনআনাহ এর প্রতি দৃষ্টিপাত করি না- হোক সহীহায়নের মধ্যে বা সহীহায়নে বাইরের কিতাবসমূহের মধ্যে। [শরহু কিতাবিত তাদলীস: ৪/৫]
📗 মুদাল্লিস রাবীর হাদীস দুই প্রকার:
১. সুনির্দিষ্ট প্রমাণের ভিত্তিতে পূর্বের রাবী থেকে তার শ্রবন প্রমাণিত। যেমন: যখন রাবী তাঁর শায়খ থেকে বর্ণনা করেন।
২. সুনির্দিষ্ট প্রমাণের ভিত্তিতে পূর্বের রাবী থেকে তার শ্রবন প্রমাণিত নয়। যেমন: যখন রাবী তাঁর শায়খ ব্যতীত সমকালীন কারো থেকে বর্ণনা করেন যার সাথে তাঁর দেখা হয়নি বা দেখা হয়েছে কিন্তু শ্রবণ হয়নি।
তো প্রথম প্রকার তো নিঃসন্দেহে গ্রহণযোগ্য, কারণ এই প্রকারে তো তাদলীস পাওয়াই যায় না। বরং অন্যান্য সিকাহ রাবীর মতো তিনি তাঁর শায়খ থেকে সরাসরি থেকে বর্ণনা করেছেন। তাদলীস তো তখন হবে যখন তিনি পূর্বের রাবী থেকে শ্রবণ না করেও এমন ভাবে বর্ণনা করবেন যে মনে হবে তিনি তার থেকে শ্রবণ করেছেন। অথচ এই হাদীসে তিনি সরাসরি তাঁর শায়খ থেকেই বর্ণনা করেছেন।
আর মুদাল্লিস রাবীর হাদীস প্রত্যাখ্যান করা হয় পূর্বের রাবী থেকে শ্রবণ না থাকায় সন্দেহের কারণে। এখানে যেহেতু সন্দেহই নেই সেহেতু এমন হাদীস মুত্বলাকান গ্রহণযোগ্য। মূলত যেখানে ইল্লতই নেই সেখানে মা'লূল কোত্থেকে আসবে?
সারকথা: রাবী ব্যক্তিগতভাবে মুদাল্লিস হলেও তাঁর হাদীসটি মুদাল্লাস নয়, মুদাল্লাস হাদীস বলা হয় যে হাদীসটি রাবী তার পূর্বের রাবী থেকে শুনবে না বরং তাদলীস করবে। কিন্তু এ হাদীসটি তিনি সরাসরি তাঁর শায়খ থেকে শুনেছেন।
📗 উসূল: অধিকাংশ মুহাদ্দিসের উসূল হচ্ছে, দ্বিতীয় তবকার মুদাল্লিস রাবীর হাদীস গ্রহণযোগ্য। দেখুন- [শরহু নুখবাহ —খুজায়ের: ৬/৯। শরহুল-লু'লু' আল-মাকনূন: ১৩/৫]
সালাফী শায়খ বিন বায এর বিশিষ্ট ছাত্র শায়খ আব্দুল করিম খুজায়ের বলেন-
وقع في التدليس أئمة كبار، الحافظ ابن حجر قسم المدلسين إلى خمس طبقات: من لم يوصف بذلك إلا نادرا، يعني حصل منه مرة أو مرتين كيحيى بن سعيد الأنصاري، الثانية: من احتمل الأئمة تدليسه وأخرجوا له في الصحيح لإمامته وقلة تدليسه كالثوري، أو لكونه لا يدلس إلا عن ثقة كابن عيينة، الطبقة الأولى والثانية ما فيها إشكال، يروى عنهم بأي صيغة كانت؛ لأن الأئمة احتملوا تدليسهم، الكلام على الطبقة الثالثة فما دون
বড় বড় ইমামগণও তাদলীসে পতিত হয়েছেন। হাফেয ইবনে হাজার মুদাল্লিস রাবীদের পাঁচটি তবকায় বিন্যস্ত করেছেন।
প্রথম. যারা কেবল অল্প কিছু হাদীসে তাদলীস করেছেন, অর্থাৎ তাদের থেকে জীবনে একবার কিবা দুইবার তাদলীস সাব্যস্ত হয়েছে। যেমন ইয়াহয়া ইবনে সাঈদ আনসারী
দ্বিতীয়. ঐ সমস্ত ইমামগণ যাদের তাদলীস গ্রহণ করে নেওয়া হয়েছে। এবং সহীহ হাদীসের গ্রন্থসমূহে তাদের হাদীসসমূহ নেওয়া হয়েছে তাদের ইমামতের কারণে অথবা তাদের তাদলীসের সংখ্যা স্বল্পতার কারণে, যেমন সুফিয়ান সাওরী, অথবা এ কারণে যে তারা সিকাহ রাবী ব্যতীত কারো থেকে তাদলীস করতেন না, যেমন সুফিয়ান ইবনে উয়ায়নাহ।
প্রথম তবকা ও দ্বিতীয় তবকা নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই। তাদের থেকে যেকোনো শব্দে হাদীস বর্ণনা করা যাবে। কারণ ইমামগণ তাদের তাদলীস গ্রহণ করে নিয়েছেন। আলোচনার বিষয় হচ্ছে তৃতীয় অথবা তার নিচের তবকাগুলো নিয়ে। [শরহু নুখবাহ —খুজায়ের: ৬/৯]
লেখক তাঁর শরহুল-লু'লু' আল-মাকনূন গ্রন্থেও বলেন-
ما حكم رواية المدلِس؟ لا بد أن نعرف طبقات المدلسين قبل حكم رواية المدلس، قسموا المدلسين إلى خمس طبقات، منهم ما لا يدلس إلا نادراً، هذا اغتفر الأئمة تدليسه فيقبل خبره مطلقاً، ومنهم من أغتفر تدليسه لإمامته
মুদাল্লিস রাবীর রেওয়াতের হুকুম কী? মুদাল্লিস রাবীর রেওয়াতের হুকুম জানার আগে মুদাল্লিসের রাবীদের তবকা জানা ব্যতীত আমাদের উপায় নেই। ইমামগণ মুদাল্লিস রাবীর পাঁচটি স্তর ভাগ করেছেন।
১. এমন মুদাল্লিস রাবী, যারা সামান্য কিছু হাদীস ব্যতীত তাদলীস করেননি। এ স্তরের মুদাল্লিস রাবীদের তাদলীস ইমামগণ মাফ করে দিয়েছেন/ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখেছেন। অতএব তাদের হাদীসসমূহ মুত্বলাকান গ্রহণ করা হবে।
২. এমন মুদাল্লিস রাবী যাদের তাদলীস ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে তাদের ইমামত বা ইমাম হওয়ার কারণে। [শরহুল-লু'লু' আল-মাকনূন: ১৩/৫]
📗 উসূল: মুদাল্লিস দাবী সা'ঈদ ইবনে আরূবাহ’র হাদীস সংক্রান্ত উসূল
মুদাল্লিস দাবী সা'ঈদ ইবনে আরূবাহ’র হাদিস গ্রহণযোগ্য হওয়ার ব্যাপারে অন্যতম হাদীস বিশারদ শায়খ রবী শাহাতাহ ‘আত-তাদলীস ইনদা সাঈদ ইবনে আবু আরূবাহ’ নামে আলাদা একটা পুস্তিকাও রচনা করা করেছেন। তিনি লিখেন-
ولم يؤثر تدليس على مروياته قبولا وردا لان سعيد بن ابي عروبة من المرتبة الثانية كما ذكره بذالك الحافظ ابن حجر وهو ممن اغتفر تدليسه
সাঈদ ইবনে আবু আরূবাহ’র তাদলীস তার রেওয়ায়েতসমূহে কোনো ধরনের প্রভাব ফেলবে না। কেননা সাঈদ ইবনে আবু আরূবাহ দ্বিতীয় তবকার মুদাল্লিস- যেমনটা হাফিজ ইবনে হাজার বলেছেন। এবং তিনি হচ্ছেন ঐ সকল রাবীদের অন্তর্ভুক্ত যাদের তাদলীস মাফ করে দেওয়া হয়েছে। [আত-তাদলীস ইনদা সাঈদ ইবনে আবু আরূবাহ: পৃষ্ঠা-৯]
শায়খ বিন বায এর বিশিষ্ট ছাত্র শায়খ আব্দুল করিম খুজায়ের তাঁর শারহুল-লু'লু' গ্রন্থে লিখেন-
ومنهم من أغتفر تدليسه لإمامته
কিছু মুদাল্লিস রাবী এমন রয়েছেন, যাদের তাদলীস তাদের ইমামতের কারণে মাফ করে দেওয়া হয়েছে। শারহুল-লু'লু': ৫/১৩
এবার সাঈদ ইবনে আবু আরূবাহ ইমাম ছিলেন। হাফেয যাহাবী তাঁর ব্যাপারে বলেন-
سعيد بن أبي عروبة ، الإمام ، الحافظ عالم أهل البصرة ، وأول من صنف السنن النبوية واسع الحديث عالم فقيه كبير الشأن
সাঈদ ইবনে আবু আরূবাহ। তিনি ইমাম, হাফেযুল হাদীস, আহলে বসরার আলেম, এবং তিনিই সর্বপ্রথম সুন্নাতে নববীয়্যাহ’র উপর গ্রন্থ লিখেন। এবং তিনি হাদিস সম্পর্কে অত্যন্ত প্রশস্ত জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন এবং তিনি ছিলেন মহান মর্যাদাবান ফকীহ। [সিয়ারু আলামিন নুবালা: ৬/৪১৩ ও অন্যান্য]
📗 মুদাল্লিস রাবী কাতাদা রহ. এর হাদিস সংক্রান্ত উসূল
হাফেয ইবনে হাজার রহ. কাতাদা রহ. সম্পর্কে বলেন-
من احتمل الأئمة تدليسه
তিনি (কাতাদা) এমন মুদাল্লিস রাবি, যার তাদলীস ইমামগণ গ্রহণ করে নিয়েছেন। [আল-'ইলাল: ১/৪৮৮]
তার উপর কাতাদা রহ. দ্বিতীয় স্তরের মুদাল্লিস। আর উসুল হচ্ছে দ্বিতীয় স্তরের মুদাল্লিসের বর্ণনা ইমামদের নিকট গ্রহণযোগ্য- যা আমরা গত ওপরে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
📗 একটি ভুল সংশোধন
সমকালীন লিখক মুহাম্মদ হাসান আব্দুল গাফফার লিখেন-
قول أكثر الأحناف، وبعض المالكية، بأن الأصل في رواية المدلس القبول مطلقا، سواء عنعن أو صرح بالتحديث.
অধিকাংশ আহনাফ এবং কিছু মালেকীদের মতে মুদাল্লিস রাবীর বর্ণনা মুতলাকান গ্রহণ করা হবে, চাই আন-যুক্ত হোক কিংবা স্পষ্ট বর্ণনা। [শরহু কিতাবিত তাদলীস: ৫/৭- শামেলা]
তবে তাঁর এই তথ্যটি পুরোপুরি সঠিক নয়। কারণ, এটি কেবল অধিকাংশ হানাফী এবং কিছু মালেকীদের মত নয় বরং এটা হচ্ছে অধিকাংশ উলামায়ে কেরামের মত। যেমন ৬০০ হিজরীর ইমাম ইবনু ফারহ রহ. (৬২৪-৬৯৯) বলেন-
خلاصة القول في هذا أن للعلماء ثلاثة أقوال: القبول مطلقا، وهو قول جمهور من قبل المرسل، فلم يجعلوا المدلس مثل الكذاب، ولم يروا صفة التدليس جرحا في العدالة، وغاية ما في الأمر أن يكون بمعنى الإرسال
তাদলীসের ক্ষেত্রে সারকথা হচ্ছে, (এ ব্যাপারে) উলামাদের তিনটি মত রয়েছে
১. মুতলাকান (নিঃশর্ত) গ্রহণযোগ্য -মুরসালের মতো হওয়ায়। আর এটাই হচ্ছে জমহুর (অধিকাংশ) উলামায়ে কেরামের মত। আর জমহুর উলামায়ে কেরাম মুদাল্লিসকে মিথ্যুকের মতো সাব্যস্ত করেননি। এ ব্যাপারে সারকথা হচ্ছে, তাদলীসকে ইরসালের অর্থে গ্রহণ করা হবে।
মুদাল্লিস রাবীর হাদীস অধিকাংশ উলামায়ে কেরামের মতে মুতলাকান (সর্বাবস্থায়) গ্রহণযোগ্য হওয়ার ক্ষেত্রে হাফেয জালালুদ্দীন সুয়ূতী রহ. এর বক্তব্য থেকেও প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি বলেন-
وَقَالَ جُمْهُورُ مَنْ يَقْبَلُ الْمُرْسَلَ: يَقْبَلُ مُطْلَقًا، حَكَاهُ الْخَطِيبُ
জমহুর উলামায়ে কেরাম- যারা মুরসালকে গ্রহণ করেন, তাঁরা বলেন- মুদাল্লিস রাবির বর্ণনা মুতলাকান (‘আন’যুক্ত হোক বা না হোক, সর্বাবস্থায়) গ্রহণ করা হবে। এমনটাই নকল করেছেন খতীব বাগদাদী। —তাদরীবুর রাবী: ১/২৬২
লুবাব হাসান সাফওয়ান
কোন মন্তব্য নেই