আবূ বকর ও ওমর রা. কুরবানী দেননি কেন: সংক্ষিপ্ত তাহকীক
বর্তমানে কিছু ভাই দাবি করে থাকে, লোকেরা কুরবানীকে ওয়াজিব মনে করবে- এই ভয়ে আবূ বকর ও ওমর রা. কুরবানী দেননি! এমনকি সমসাময়িক কালের কিছু কিছু কিতাবেও সহীহ সূত্রে বর্ণনার দাবি করা হয়, আবূ বকর ও ওমর রা. কুরবানী দেননি এই ভয়ে যে, লোকেরা মনে করবে তা ওয়াজিব।
কিন্তু আসলেই কি এই বর্ণনা সহীহ সূত্রে প্রমাণিত ও গ্রহণযোগ্য? বা এই বর্ণনার সঠিক ব্যাখ্যাই বা কী? আমাদের দৃষ্টিতে এ বিষয়ে কোনো তাহকীক পরিলক্ষিত হয়নি। ইনশাআল্লাহ, আজকের প্রবন্ধে এ বিষয়ে সংক্ষিপ্ত হলেও কিছুটা বিস্তারিত আলোকপাত করবো। ওয়াল্লাহুল মুসতা'আান।
প্রথম কথা: বর্ণনাটি গ্রহণযোগ্য কিনা
উত্তর: এই বর্ণনাটি একাধিক কারণে অগ্রহণযোগ্য
১. মূলত এই বর্ণনাটি সহীহ সূত্রে প্রমাণিতই নয়; বরং এটি সম্পূর্ণ সনদ বিচ্ছিন্ন একটি কথা। এ কথা সর্বপ্রথম ইমাম শাফে'ঈ বলেছেন। তাঁর পূর্বে হুবহু এমন কথা আর কেউই বলেননি। আর তিনিও তা বলেছেন সনদ ছাড়া। তাঁর বক্তব্য হলো এই-
وَقَدْ بَلَغَنَا أَنَّ أَبَا بَكْرٍ وَعُمَرَ كَانَا لَا يُضَحِّيَانِ كَرَاهِيَةَ أَنْ يُقْتَدَى بِهِمَا لِيَظُنَّ مَنْ رَآهُمَا أَنَّهَا وَاجِبَةٌ
ইমাম বায়হাকীও নিজের গ্ৰন্থে ইমাম শাফে'ঈ থেকে তা-ই বর্ণনা করেন
قَالَ الشَّافِعِيُّ: وَقَدْ «بَلَغَنَا أَنَّ أَبَا بَكْرٍ الصِّدِّيقَ وَعُمَرَ كَانَا لَا يُضَحِّيَانِ كَرَاهِيَةَ أَنْ يُقْتَدَى بِهِمَا، فيَظُنَّ مَنْ رَآهُمَا أَنَّهَا وَاجِبَةٌ»
অনুবাদ: শাফে'ঈ বলেন, আমাদের কাছে পৌঁছেছে যে, আবূ বকর ও ওমর রা. কুরবানী দেননি এ বিষয়টির অপছন্দতার কারণে যে, লোকেরা তাদের অনুসরণ করবে। কেননা, তারা মনে করবে, আবূ বকর ও ওমরের রায় হলো তা ওয়াজিব। [আল-উম্ম: ২/২৩৬, সুনানুল কুবরা: ১৯/২৬৪, সুনানুস সাগীর: ২/২২২]
কিন্তু ইমাম শাফে'ঈ রহ. এর কোনো সনদই উল্লেখ করেননি বা করতে পারেননি। কাদের মাধ্যমে তিনি এ খবর পেয়েছেন বা কে তাঁকে এ খবর জানিয়েছে, তারও কোনো হদিস নেই।
২. তাঁর এই বক্তব্যটি সহীহ সূত্রে আসা বর্ণনাসমূহের বিপরীত। সহীহ সূত্রে কেবল এতটুকু এসেছে যে, আবূ বকর ও ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু (এক/দুই বছর) কুরবানি দেননি। কিন্তু কেন কুরবানী দেননি, অর্থাৎ লোকেরা কুরবানীকে ওয়াজিব মনে করবে- সে ভয়ে নাকি অন্য কোনো কারণে- সহীহ সূত্রে এমন কোনো কথা বিধৃত হয়নি। ইমাম বায়হাকী বর্ণনা করেন-
أَخْبَرَنَا أَبُو عَبْدِ اللَّهِ الْحَافِظُ، أَخْبَرَنِي مُحَمَّدُ بْنُ أَحْمَدَ بْنِ بَالَوَيْهِ، حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ غَالِبٍ، حَدَّثَنَا مُسْلِمُ بْنُ إِبْرَاهِيمَ، حَدَّثَنَا شُعْبَةُ، عَنْ سَعِيدِ بْنِ مَسْرُوقٍ، عَنِ الشَّعْبِيِّ، عَنْ أَبِي سَرِيحَةَ قَالَ: «أَدْرَكْتُ أَبَا بَكْرٍ وَعُمَرَ، وَكَانَا لِي جَارَيْنِ وَكَانَا لَا يُضَحِّيَانِ»
অনুবাদ: আবী সারীহাহ রা. থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, আবূ বকর ও ওমর আমার প্রতিবেশী ছিলেন। আমি আবূ বকর ও ওমরকে পেয়েছি যে, তাঁরা কুরবানী দেননি। [মারেফাতুস সুনান: ১৪/১৬]
ব্যস এতটুকুই। মূল বর্ণনাতে এর বেশি কিছু নেই। ইমাম বায়হাকী তাঁর সুনানেও বর্ণনা করেন-
أَخْبَرَنَا أَبُو الْحُسَيْنِ بْنُ بِشْرَانَ، أَنَا أَبُو الْحَسَنِ الْمِصْرِيُّ، نَا ابْنُ أَبِي مَرْيَمَ، نَا الْفِرْيَابِيُّ، ثَنَا سُفْيَانُ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ مُطَرِّفٍ، وَإِسْمَاعِيلَ، عَنِ الشَّعْبِيِّ، عَنْ أَبِي سَرِيحَةَ يَعْنِي حُذَيْفَةَ بْنَ أَسِيدٍ الْغِفَارِيَّ، قَالَ: «أَدْرَكْتُ أَبَا بَكْرٍ، أَوْ رَأَيْتُ أَبَا بَكْرٍ وَعُمَرَ لَا يُضَحِّيَانِ.
অনুবাদ: আবী সারীহাহ রা. থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, আমি আবূ বকরকে পেয়েছি বা আবূ বকর ও ওমরকে দেখেছি যে, তাঁরা কুরবানী দেননি। [সুনানুল কুবরা: ১৯/২৬৪, সুনানুস সাগীর: ২/২২২]
একইভাবে ইমাম ইবনে কাসীরও বর্ণনা করেন-
أنا أبو عبد الله الحافظ، أخبرني محمد بن أحمد بن بَالُويه، ثنا محمد بن غالب، ثنا مسلم بن إبراهيم، ثنا شعبة، عن سعيد بن مسروق، عن الشَّعبي، عن أبي سَرِيحة قال: أدركتُ أبا بكرٍ وعمرَ وكانا لي جَارَيْن، وكانا لا يُضحِّيان.وهذا إسناد صحيح
অনুবাদ: আবী সারীহাহ রা. থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, আবূ বকর ও ওমর আমার প্রতিবেশী ছিলেন। আমি আবূ বকর ও ওমরকে পেয়েছি যে, তাঁরা কুরবানী দেননি। এই বর্ণনার সনদ সহীহ। [মুসনাদুল ফারূক— ইবনে কাসীর: ১/৫৩৭]
মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাকেও হাদীসটি এসেছে এভাবে যে-
٨١٣٩ - عَنِ الثَّوْرِيِّ، عَنْ إِسْمَاعِيلَ، وَمُطَرِّفٌ، عَنِ الشَّعْبِيِّ، عَنْ أَبِي سُرَيْحَةَ قَالَ: «رَأَيْتُ أَبَا بَكْرٍ، وَعُمَرَ وَمَا يُضَحِّيَانِ»
অনুবাদ: আমি আবূ বকর ও ওমরকে দেখেছি যে, তাঁরা কুরবানী দেননি। [মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক: হাদীস নং ৮১৫৯]
এই হলো মূল বর্ণনা। মূল বর্ণনায় কেবল কুরবানী না দেওয়ার বিষয়টি এসেছে। এর বেশি কিছু, অর্থাৎ ‘লোকেরা কুরবানীকে ওয়াজিব মনে করার ভয়ে তাঁরা কুরবানী দেননি' এমন কিছু বর্ণিত হয়নি। ‘ওয়াজিব মনে করার’ বিষয়টি মূলত ইমাম শাফে'ঈর নিজস্ব বক্তব্য বা ব্যাখা। এটা কেবল আমার দাবি নয়, খোদ ইমাম বায়হাকী ও অন্যান্য ইমামগণেরও দাবি এটা! বায়হাকী তাঁর সুনানুস সাগীর-এ উপরিউক্ত বর্ণনা উল্লেখ করে বলেন-
قَالَ الشَّافِعِيُّ: يَعْنِي فَيَظُنُّ مَنْ رَآهُمَا أَنَّهَا وَاجِبَةٌ
শাফে'ঈ এর ব্যাখ্যায় বলেন- ‘কারণ, লোকেরা ধারণা করতে পারে যে, তাঁদের মতে কুরবানী ওয়াজিব। [সুনানুস সাগীর: ২/২২২, বর্ণনা নং: ১৮১৪]
বায়হাকী ও অন্যরা না বললেও এটিই নিরন্তর সত্য যে ‘লোকেরা ওয়াজিব মনে করবে’ এই অংশটুকু ইমাম শাফে'ঈর নিজস্ব সংযোজন। কারণ, এই হাদীসটি যত ‘মতনেই’ বর্ণিত হয়েছে, কোনো মতনেই ‘লোকেরা ওয়াজিব মনে করবে’ এই বাড়তি অংশটুকু নেই। কেবল ইমাম শাফে'ঈর বক্তব্যেই এই কথাটি পাওয়া যায়।
৩. হ্যাঁ, কোনো কোনো বর্ণনায় মূল হাদীসের সাথে আরো একটু বাড়তি কথা আছে। ইমাম বায়হাকী তা হাদীসের শেষাংশে ও অন্যত্র আলাদাভাবে উল্লেখ করেছেন। তা হলো-
فِي بَعْضِ حَدِيثِهِمْ: كَرَاهِيَةَ أَنْ يُقْتَدَىَ بِهِمَا»
অর্থাৎ কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে- (তাঁরা কুরবানী ছেড়ে দিয়েছেন,) এ বিষয়টির অপছন্দতার কারণে যে, লোকেরা এ বিষয়ে তাঁদের অনুসরণ করবে। [মারেফাতুস সুনান: ১৪/১৬, সুনানুল কুবরা: ১৯/২৬৪, সুনানুস সাগীর: ২/২২২]
প্রথমত: এ বর্ণনাতেও ‘লোকেরা ওয়াজিব মনে করবে' এ বিষয়টি নেই; বরং বলা হয়েছে, ‘লোকেরা এ বিষয়ে তাদের অনুসরণ শুরু করে দেবে’। দ্বিতীয়ত: এই বাড়তি অংশটি মূল বর্ণনায় নেই; এটিও অন্যদের সংযোজনমাত্র।
আর যদি সঠিক ধরেও নিই; তবুও ইমাম শাফে'ঈর কথা এ কথার ব্যাখ্যা হতে পারে না। বরং এটি শাফে'ঈর বক্তব্যের রদ। কারণ, ‘লোকেরা কুরবানীকে ওয়াজিব মনে করবে’ আর ‘লোকেরা কুরবানী বিষয়ে তাদের অনুসরণ শুরু করে দেবে’ এ দুটো এক কথা নয়, বরং বিপরীতধর্মী কথা। কেননা, দাবি অনুযায়ী কুরবানী যদি সুন্নতে মুআক্কাদা হয়, তাহলে সুন্নতে মুআক্কাদার ক্ষেত্রে তাদের অনুসরণ করলে ক্ষতি কী? কেন সুন্নতে মুআক্কাদার ক্ষেত্রে তাদের অনুসরণের ভয়ে তাঁরা নিজেদের জন্য সুন্নতে মুআক্কাদা ছেড়ে দেবেন! মানুষের ব্যাপক অনুসরণের ভয়ে কি সুন্নতে মুআক্কাদা ছেড়ে দেওয়া জায়েয হবে আদৌ? বলাবাহুল্য, রাসূলের সুন্নাত ব্যাপক অনুসৃত হবে, এটা তো আরো খুশীর কথা!
তাছাড়া ‘মুআক্কাদা' মানেই তো অধিক গুরুত্বপূর্ণ বা ‘তাকীদপূর্ণ’ আমল। তাহলে মানুষ কুরবানীকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বা ‘তাকীদপূর্ণ’ আমল মনে করলে সমস্যা কোথায়? আর অনেকের নিকট তো সুন্নতে মুআক্কাদা ও ওয়াজিব সমপর্যায়ের। উভয়টাই প্রায় সমান গুরুত্বপূর্ণ। তাহলে তাঁরা সুন্নতে মুআক্কাদা ছেড়ে দিয়ে কি মানুষকে এটা শিখিয়েছেন যে, সুন্নতে মুআক্কাদা ছেড়েও দেওয়া যায়?
মোটকথা, সুন্নতে মুআক্কাদার ক্ষেত্রে তো চাইলে তাঁদের অনুসরণ করাই যায়; এ জন্য তো তাঁদের নিজেদের কুরবানী ছেড়ে দিতে হবে না। আর সুন্নতে মুআক্কাদা তো এমন আমল নয়, যাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করলে বিদ'আতে পরিণত হতে পারে!
তাছাড়া এ বর্ণনাতে এসেছে- أَنْ يُقْتَدَىَ بِهِمَا; অর্থাৎ ‘তাঁরা কুরবানী ছেড়ে দিয়েছিলেন এ বিষয়ে তাঁদের উভয়ের অনুসরণের ভয়ে’। কিন্তু আমরা জানি, কুরবানী করা আবূ বকর ও ওমর রা. এর অনুসরণ নয়; বরং রাসূলের অনুসরণ। রাসূল সা. কখনো কুরবানী পরিত্যাগ করেননি। অতএব, এ বিষয়ে মানুষজন তাদের উভয়ের অনুসরণের মুখাপেক্ষী নয়, বরং রাসূলের অনুসরণই তাদের জন্য যথেষ্ট। যদি বলা হয়, ছেড়ে না দেওয়ার ব্যাপারে মানুষেরা তাঁদের অনুসরণ করবে; তাহলে বলবো, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তো কখনো কুরবানী ছেড়ে দেননি।
আর তাঁদের অনুসরণে কোনো আমল করা তাঁদের অপছন্দের কারণ তখনই হবে, যখন আমলটি শরী'আহ কর্তৃক সুন্নতে মুআক্কাদা বা ওয়াজিব না হবে; বরং তাঁদের নিজস্ব আমল বা নফল হবে।
সুতরাং, এখানে তাদের অনুসরণের কথা বলে এটাই বোঝানো হয়েছে যে, এটি সুন্নতে মুআক্কাদা বা ওয়াজিব কুরবানী নয়, বরং তাঁদের নিজস্ব আমল বা নফল কুরবানী। কেননা, নফল কুরবানীর ক্ষেত্রেই তাঁদের অনুসরণ সম্ভব। সুন্নতে মুআক্কাদা হলে তো প্রকারান্তরে রাসুলেরই অনুসরণ হবে।
অতএব, আকল-নাকল ও দলীল-প্রমাণের ভিত্তিতে এ কথা সুপ্রমাণিত যে, ‘লোকেরা এ বিষয়ে তাদের অনুসরণ শুরু করে দেবে’ এমন কথা সুন্নতে মুআক্কাদার ক্ষেত্রে কখনোই প্রযোজ্য হতে পারে না, বরং এমন কথা কেবল নফলের ক্ষেত্রেই বলা সম্ভব হতে পারে।
সুতরাং, উপরিউক্ত বক্তব্যের ব্যাখ্যায় ইমাম শাফে'ঈর ‘লোকেরা ওয়াজিব ধারণা করবে’- এই ব্যাখ্যা করা একেবারেই সঠিক নয়।
৪. আবূ বকর ও ওমর রা. কি ওয়াজিব কুরবানী ছেড়ে দিয়েছিলেন?
ইতোপূর্বে আমরা দাবি করেছিলাম, তাঁরা সুন্নতে মুআক্কাদা নয়; বরং নফল কুরবানীই ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু আমরা যথাসময়ের অপেক্ষায় এর পক্ষে কোনো দলীল উপস্থাপন করিনি। ইনশাআল্লাহ, এ পর্যায়ে আমরা দলীল-প্রমাণসহই সাবেত করে দেবো যে, আবূ বকর ও ওমর রা. মূলত নফল কুরবানীই ছেড়ে দিয়েছিলেন।
এ বিষয়ে হাফেয যাহাবী রহ. স্বীয় গ্রন্থে সবচেয়ে বিশুদ্ধ বর্ণনাটি উল্লেখ করেন। মজার ব্যাপার হলো খোদ ইমাম বায়হাকীও এই বর্ণনা উল্লেখ করেছেন। দেখুন- সুনানুল কুবরা: ১৯/২৬৪। কিন্তু বিরোধীরা এই বর্ণনা ভুলেও উল্লেখ করেন না। বর্ণনাটি হলো এই—
عن حُذَيفَةَ بنِ أَسِيدٍ قال: لَقَد رأيتُ أبا بكرٍ و عُمَرَ وما يُضَحِّيانِ عن أهلِهِما؛ خَشيَةَ أن يُستَنَّ بهِما، فلَمّا جِئتُ بَلَدَكُم هذا حَمَلَنِى أهلِى على الجَفاءِ بَعدَ ما عَلِمتُ السُّنَّةَ
অনুবাদ: হুযায়ফাহ বিন আসীদ রা. থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, আমি আবূ বকর ও ওমরকে দেখেছি যে তাঁরা নিজেদের ‘আহাল' (পরিবার) এর পক্ষ থেকে কুরবানী দেননি, এই ভয়ে যে লোকেরা এ (নফল) বিষয়ে তাঁদের অনুসরণ শুরু করে দেবে। কিন্তু যখন আমি তোমাদের এই শহরে আসলাম, সুন্নাহ জানার পর আমার স্ত্রী আমার ওপর বিষয়টি চাপিয়ে দিলো। [আল-মুহাযযাব— যাহাবী: ৮/৩৮৪৬]
উল্লেখ্য: সর্বজনবিদিত কথা যে, পরিবার বা স্ত্রীর পক্ষ থেকে কুরবানী দেওয়া নফল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও কখনো কখনো নিজের ‘আহাল'গণের পক্ষ থেকে নফল কুরবানী আদায় করতেন।
অতএব, হাদীসের আলোকেই সুপ্রমাণিত যে, তাঁরা যে কুরবানী ছেড়ে দিয়েছিলেন তা স্রেফ নফল কুরবানীই ছিলো। ওয়াজিব বা সুন্নতে মুআক্কাদা নয়। কিন্তু মানুষজন এই নফল কুরবানীর ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে তাঁদের অনুসরণ শুরু করে দেবে- এই ভয়ে তাঁরা মাঝে মধ্যে তাঁরা নিজেদের নফল কুরবানী ছেড়ে দিতেন। আর সেই নফল কুরবানী হলো নিজ ‘আহাল' বা পরিবারের পক্ষ থেকে কুরবানী করা। অর্থাৎ তাঁরা মাঝে মধ্যে নিজ ‘আহাল’ এর পক্ষ থেকে কুরবানী দিতেন না, যেন মানুষ পরিবারের পক্ষ থেকে এই নফল কুরবানীকে নিজেদের জন্য আবশ্যক করে না নেয় বা এটিকে আবূ বকর ও ওমরের সুন্নত মনে না করে।
সুতরাং, এতোসব দলীল-প্রমাণের আলোকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো যে, ‘সুন্নতে মুআক্কাদাকে ওয়াজিব মনে করা’র বিষয়টি ইমাম শাফে'ঈর একান্ত নিজস্ব বক্তব্য। তিনি ছাড়া ‘ওয়াজিব মনে করা’র বিষয়টি আর কেউই বলেননি। আর তাঁর এই বক্তব্যটি আরো একাধিক কারণেও অগ্রহণযোগ্য; সামনে তা প্রমাণিত হবে।
৫. সনদের সাথে সাথে এই বর্ণনার মতনও অসংলগ্ন। কারণ, কুরবানী ওয়াজিব না, তা বোঝানোর জন্য একে একে দু'জন মহান খলীফা ও সাহাবী কুরবানীর মতো এক মহান গুরুত্বপূর্ণ শর'ঈ বিধান তরক করবেন- তা অযৌক্তিক। কুরবানী ওয়াজিব নয়- এ ব্যাপারে মৌখিক কিংবা লিখিত হুকুম জারি করে দিলেই তো পারতেন। এতে করে বিষয়টি ব্যাপক আকারে প্রচারিত হয়ে যেতো। অথচ তা না করে কুরবানী তরক করে বোঝাচ্ছেন যে, কুরবানী ওয়াজিব নয়। তাও একজন নয়, একে একে দুই, তিন, চার, ছয়জন সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবী! কেন, একজন সাহাবীর আমলের ওপর কি বাকীদের ভরসা ছিলো না?
৬. ঘটনা যদি বাস্তবিকই এমন হতো যে, তাঁরা প্রচলিত কুরবানীকে ওয়াজিব মনে করার ভয়ে ছেড়ে দিয়েছিলেন, তাহলে আশা করা যায়, কুরবানী ওয়াজিব নাকি সুন্নাত- এই বিষয়ে কোনো ইখতিলাফই সৃষ্টি হতো না। কারণ, এ বিষয়টি সাহাবী যুগ থেকেই ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে যেতো যে, কুরবানী ওয়াজিব নয় বরং সুন্নাত। এবং সহাবীগণের এই সুন্নতে মুআক্কাদা কুরবানীকে ‘কুরবানী' (ত্যাগ) করার বিষয়টি সুপ্রসিদ্ধ হাদীসগ্রন্ত্র ও সুনির্ভরযোগ্য ইতিহাসগ্ৰন্থসমূহে আসতো, অথচ সুপ্রসিদ্ধ হাদীসগ্রন্ত্র ও ইতিহাসগ্ৰন্থসমূহে এই ঐতিহাসিক কেচ্ছাটি দেখতে পাওয়া যায় না।
সারাংশ
১. লোকেরা কুরবানীকে ওয়াজিব মনে করবে- এই ভয়ে আবূ বকর ও ওমর রা. কুরবানী দেননি! এই বর্ণনা একাধিক কারণে গ্রহণযোগ্য নয়। তন্মধ্যে প্রধান কারণ হলো, এটি ইমাম শাফে'ঈর একান্ত নিজস্ব বক্তব্য এবং তা বাস্তবতাবহির্ভূত। বিস্তারিত আলোচনা লিঙ্কে।
২. মূল বর্ণনায় কেবল এতটুকুই এসেছে যে- সাহাবীদ্বয় কখনো কখনো কুরবানী দেননি। কেন দেননি তা বিধৃত হয়নি। তবে এর উত্তর হলো, খুব সম্ভব কখনো কখনো তাঁদের কুরবানী দেওয়ার মতো সামর্থ্য থাকতো না। যেমন আমরাও কখনো কুরবানি দিই আবার কখনো দিই না, সামর্থ্য না থাকার কারণে। তাছাড়া তারা এমনিতেই অভাব অনটনের মধ্যে দিনাতিপাত করতেন।
৩. যে বর্ণনায় এসেছে, كَرَاهِيَةَ أَنْ يُقْتَدَىَ بِهِمَا; (অর্থাৎ লোকেরা এ বিষয়ে তাঁদের অনুসরণ শুরু করবে- এ কারণে...) প্রথমত: এ কথাটি মূল বর্ণনায় নেই, বরং এটি অন্যদের সংযোজন। দ্বিতীয়ত: এ বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত হয়, তা ছিলো নফল কুরবানী। কারণ, সুন্নতে মুআক্কাদার ক্ষেত্রে কারো অনুসরণ করলে কোনো ক্ষতি নেই। কেননা, তা মূলত রাসূলেরই অনুসরণ। হাঁ, নফলের ক্ষেত্রেই নির্দিষ্ট কারো অনুসরণ দোষনীয়। অতএব বুঝা গেল যে, এটি নফল কুরবানী ছিলো, এ কারণে তাঁরা এ বিষয়ে নিজেদের অনুসরণকে ভয় পাচ্ছিলেন।
৪. হাফেয যাহাবী ও ইমাম বায়হাকীর সুনানুল কুবরা এর ১৯০৬৭ নং বর্ণনা থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে, তা ছিলো পরিবারের পক্ষ থেকে নফল কুরবানী। অর্থাৎ, তাঁরা মাঝেমধ্যে পরিবারের পক্ষ থেকে কুরবানী দিতেন না, যাতে করে মানুষ পরিবারের পক্ষ থেকে কুরবানী দেওয়াকে জরুরী না মনে করে এবং এ ক্ষেত্রে তাঁদের অনুসরণ না করে।
৫. অতএব, পরিবারের পক্ষ থেকে নফল কুরবানী ছেড়ে দেওয়ার ওপর ভিত্তি করে ‘ওয়াজিব কুরবানীকে সুন্নতে মুআক্কাদা’ বানিয়ে দেওয়া অনেক বড় ইলমী পদস্খলন।
.
লুবাব হাসান সাফওয়ান
জবরদস্ত
উত্তরমুছুনমাশাআল্লাহ
উত্তরমুছুনজাজাকাল্লাহ ❤️
জাযাকাল্লাহু খইরন
উত্তরমুছুন