রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেন টাকা দ্বারা ফিতরা আদায় করেননি?
নামধারী আহলে হাদীসরা প্রশ্ন করে থাকে, টাকা দ্বারা যদি ফিতরা আদায় করা জায়েজ হতো তাহলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আদায় করেননি কেনো? এবং তারা মনে করে, এটি এমন একটি লা-জবাব প্রশ্ন- যার কোনো জবাব হতেই পারে না। কিন্তু আমরা এই প্রবন্ধে সে প্রশ্নের জবাবটাই দেওয়ার চেষ্টা করব।
যেহেতু কেবল এই প্রশ্নের জবাব দেবো, সেহেতু টাকা দ্বারা ফিতরা আদায় করা জায়েয হওয়া সম্পর্কে আমাদের কাছে অনেক দলিলাদি থাকা সত্ত্বেও আমরা সেগুলো উল্লেখ করবো না।
যাইহোক, এবার মূল বিষয়ে আসি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেন টাকা দ্বারা ফিতরা আদায় করেননি?
সংক্ষিপ্ত জবাব
ফিতরা আদায় করতে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা লাগে। কিন্তু রাসুলের যুগে ২০০-৩০০ টাকার খুচরো ছিলো না। সে যুগে মুদ্রা হিসেবে দীনার-দিরহাম ব্যবহার করা হতো। কিন্তু দীনার-দিরহামেরষর মূল্য ছিল অনেক; প্রায় ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা। কাজেই তিনি টাকা দ্বারা ফিতরা আদায় করেননি। মূলত সে যুগে টাকা দ্বারা ফিতরা আদায় করা সম্ভবই ছিলো না।
বিস্তারিত জবাব
ধরুন, আপনার কাছে কেউ ২০০ টাকা পায়, কিন্তু মেনে নিন, বর্তমান বাংলাদেশে ৫০০ টাকার নিচে কোনো নোট নেই। ৫০-১০০ টাকার নোটগুলো বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যেমন আগে ১ পয়সা, ৫ পয়সা, ১০ পয়সা, ২৫ পয়সা, ৫০ পয়সা ছিলো, এখন বিলুপ্ত।
তখন আপনি পাওনাদারকে কীভাবে ২০০ টাকা পরিশোধ করবেন?
অবশ্যই ২০০ টাকার বিনিময়ে পাওনাদারকে ২০০ টাকার সমপরিমাণ খাদ্য দ্রব্য বা অন্য কিছু দিতে হবে। যেমন বর্তমানে দোকানীরা ১-২ টাকা খুচরো না থাকলে এর বিনিময়ে কাস্টমারকে সমমূল্যের লজেন্স বা চুইঙ্গাম দিয়ে থাকে। কারণ, খাদ্য দেওয়া ছাড়া এক্ষেত্রে আর কোনো উপায় থাকে না।
লজেন্স বা চুইঙ্গাম দেওয়ার একটাই কারণ, তা হচ্ছে দোকানীর কাছে ঐ পরিমাণ খুচরো টাকা নেই। যদিও তার কাছে অনেক বড় বড় হাজারী নোট রয়েছে।
তো টাকা থাকা সত্ত্বেও সে টাকা না দিয়ে খাদ্য দিচ্ছে- এর অর্থ হচ্ছে তার কাছে খুচরো টাকা নেই। এটা অত্যন্ত কমন বিষয়।
একইভাবে, রাসূলের যুগে দীনার-দিরহাম থাকা সত্ত্বেও তিনি দীনার-দিরহাম দিয়ে ফিতরা আদায় করেননি বা করতে বলেননি- এর অর্থ হচ্ছে সে যুগে ফিতরা আদায় করার মত খুচরো টাকা ছিলো না। কারণ, ফিতরা দিতে হয় ২০০ বা ৩০০ টাকা; অথচ তৎকালীন সময়ে ২০০-৩০০ টাকার খুচরো ছিল না। ছিলো কেবল দীনার/দিরহাম; কিন্তু এর মূল্য অনেক বেশি। তাছাড়া দীনার-দিরহাম হচ্ছে স্বর্ণ এবং রূপা। আপনি নিশ্চয়ই সদকাতুল ফিতর হিসেবে কাউকে স্বর্ণ-রূপা দান করবেন না।
কারণ, সে-যুগের এক দীনার মানে বর্তমান যুগের ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকার চেক। বিভিন্ন হাদিসে এসেছে এক দীনারে তাঁরা দুইটি ছাগল কিনতে পারতেন। এবার বর্তমান বাজারে দুইটি ছাগলের মূল্য কত হিসাব করেন, ২৫/৩০ হাজারের কমে তো হবেই না।
তো ২০/৩০ হাজারের চেক দিয়ে কি ২০০ টাকা মূল্যের ফিতরা আদায় করা সম্ভব?
আপনি কি দুই টাকার পাওনাদারকে ৩০ হাজার টাকার চেক দিয়ে বিদায় করবেন? নিশ্চয়ই না। তাহলে রাসূলের যুগে দিনার-দিরহাম দ্বারা কিভাবে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা সম্ভব ছিল? কাজেই তিনি এবং তাঁরা খাদ্য দিয়ে ফিতরা আদায় করতেন। আর এমনিতেই সে যুগে খাদ্যকেও মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করা হতো।
আরেকটা উদাহরণ দিচ্ছি- এইতো কিছুদিন আগেও আমাদের বাপদাদারা বা তাদের পূর্বপুরুষরা ১-টাকা দিয়ে বিশাল বড় বড় জমি কিনে ফেলতেন। চার আনা দিয়ে গরুর গাড়ি বোঝাই সদাই নিয়ে আসতেন।
এবার ইনসাফের সাথে বলেন দেখি, যেখানে এক টাকা দিয়ে বিশাল বড় জমি ক্রয় করা যায়, এক দীনার দিয়ে দুইটি ছাগল ক্রয় করা যায়, চার আনা দিয়ে গরুর গাড়ি বোঝাই সদাই নিয়ে আসা যায় সেখানে এক দীনার দিয়ে ফিতরা দেওয়া কীভাবে সম্ভব ছিলো? এক দীনার দিয়ে ফিতরা দেওয়া মানে দুইটা আস্ত ছাগল দিয়ে দেওয়া। কিংবা বিশাল বড় বড় জমি জমা দিয়ে দেওয়া।
আমাদের পূর্বপুরুষের যুগে এক ১ টাকা তো দূরের কথা, চার আনা দিয়েও তো ফিতরা দেওয়া সম্ভব ছিলো না। কারণ, চার আনায় এক সা খেজুরের কয়েক গুণ বেশি পাওয়া যায়। কাজেই বাধ্য হয়েই তাঁরা খাদ্য দ্বারা ফিতরা আদায় করতেন।
এখন কেউ যদি মূর্খের মতো বলে, সে যুগে দীনার-দিরহাম থাকা সত্ত্বেও তিনি এসব দিয়ে ফিতরা আদায় করেননি কেন?
তাহলে তার কাছেও আমাদের প্রশ্ন থাকবে, দোকানীর কাছে হাজার হাজার টাকা সত্ত্বেও সে পাওনাদারকে এক টাকা এবং দুই টাকার নোট কিংবা পয়সা ফেরত না দিয়ে না দিয়ে খাদ্য ফেরত দেয় কেন?
সাদাকাতুল ফিতর হিসেবে মূলত টাকা দেওয়াটাই শরীয়তের চাহিদা
এ ব্যাপারে মাওলানা আসলাম হুসাইন সাহেব খুবই সুন্দর আলোচনা করেছেন। তাঁর অন্যান্য বিষয়ের সাথে আমার মতবিরোধ থাকলেও এ ব্যাপারে তাঁর কথাগুলো আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে; তাই হুবুহু তুলে ধরার চেষ্টা করলাম। তিনি লিখেন-
“ফিতরা: টাকা নাকি খাদ্য দিয়ে?
মাকাসিদুস শারয়্যিয়াহ সম্পর্কে যাদের ধারণা নেই তারা টাকা দিয়ে ফিতরা আদায়ের ব্যাপারে আপত্তি তুলে । এক ধাপ এগিয়ে এটাকে নাজায়েজ বলে। অথচ ফিতরা প্রবর্তনের উদ্দেশ্য হচ্ছে গরিবদের প্রয়োজন পূরণে সহযোগিতা করা এবং তাদেরকে ঈদের আনন্দে শরিক করা। এখন কীসে তারা বেশি উপকৃত হবে এবং আনন্দ করতে পারবে এখানে তা মূখ্য বিষয়।
কেউ যদি কোনো গরিবকে ১০০০ টাকা দিয়ে কিনে এক সা খেজুর আর ৫০০ টাকার একটা নোট দিয়ে যে কোনো একটা গ্রহণ করতে বলে, দেখবেন সে ৫০০ টাকার নোটটাই নিবে। কারণ তার টাকার প্রয়োজন। রোহিঙ্গাদেরকে যখন ফিতরা বাবদ খাদ্য দেওয়া হয়েছিল তখন তারা সে খাদ্য অর্ধেক মূল্যে বিক্রি করে টাকা নিয়েছে বলে অনেক রিপোর্ট অনলাইনে প্রত্যক্ষ করেছি। এটাই বাস্তবতা।
হাদিসে যেসব জিনিস দিয়ে ফিতরা দিতে বলা হয়েছে, তার একটাও আমাদের দেশের গরিবদের প্রেক্ষাপটে উপকারী নয়। তাদের কাছে টাকাই কল্যাণকর ও উপকারী। এমতাবস্থায় টাকা শুধু জায়েজ নয় বরং বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে টাকা দেওয়া উত্তমও হতে পারে। তবে কেউ যদি বন্যা কবলিত এলাকায় থাকে বা এমন জায়গায় থাকে যেখানে টাকার চেয়ে খাদ্য বেশি প্রয়োজন তাহলে সেখানে খাদ্য দেওয়া উত্তম।
এক দলের দাবি হচ্ছে, রসুল সা.-এর যুগে তো মুদ্রা ছিল তাহলে তিনি মুদ্রা দিয়ে ফিতরা দেননি কেন?
বাহ্যত তাদের এই দাবি যুক্তি সংগত হলেও বাস্তবে মোটেও তা নয়। কেননা রসুল সা.- এর যুগে দুইটা মুদ্রা ছিল- স্বর্ণমুদ্রা যাকে বলা হতো দিনার ও রৌপ্যমুদ্রা যাকে বলা হতো দিরহাম। ফিতরার জন্য যেসব জিনিস যে পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে তার পরিবর্তে স্বর্ণ বা রৌপ্য দেওয়া কি সম্ভব ছিল? কখনোই নয়। এইজন্য রসুলের যুগে পণ্য দিয়ে পণ্য বেচাকেনার রীতি প্রচলন ছিল। মুদ্রা ছিল দুষ্কর ব্যাপার।
একটা উদাহরণ দেখুন, মনে করুন বাংলাদেশে কোনো কাগজের নোটের টাকা নেই। স্বর্ণের মুদ্রা রয়েছে। এমতাবস্থায় কেউ চাউল তিন কেজির পরিবর্তে স্বর্ণমুদ্রা দিতে চাচ্ছে। এখন চাউল তিন কেজির দাম ১৮০/ । আর স্বর্ণ মুদ্রার সর্বনিম্ন একক হচ্ছে রতি। বর্তমান বাজারে এক রতির দাম ১০০০+ টাকা। এখন বলুন, এই লোকের পক্ষে স্বর্ণমুদ্রা দেওয়া সম্ভব?
এইজন্য রসুল সা.-এর যুগে মুদ্রা থাকা সত্ত্বেও ছোটো খাটো জিনিস বেচাকেনার ক্ষেত্রে এইগুলো ব্যবহার হতো না। পণ্যের বিনিময়ে পণ্য ব্যবহার করা হতো। কিন্তু পরবর্তীতে সাহাবিদের যুগেই মূল্য দিয়ে ফিতরা আদায় করা শুরু হয়। হজরত মুয়াবিয়া রা. তাঁর যুগে এক সা খেজুরের পরিবর্তে এর মূল্য বিবেচনায় অর্ধ সা গম নির্ধারণ করেন। [সহিহ বুখারি: ১৫৮]
অথচ রসুল সা. গমের কথা বলে যাননি। এখন খেজুরের পরিবর্তে মূল্য বিবেচনায় যদি গম গ্রহণ করা যায় তাহলে তার মূল্য হিসেবে নগদ টাকা কেনো গ্রহণ করা যাবে না?
বিখ্যাত তাবেঈ ইমাম আবু ইসহাক বলেন, ﻭﺃﺩﺭﻛﺘﻬﻢ ﻭﻫﻢ ﻳﺆﺩﻭﻥ ﺍﻟﻘﻴﻤﺔ ﻓﻲ ﺯﻛﺎﺓ ﺍﻟﻔﻄﺮ
“আমি তাঁদেরকে মূল্য দিয়ে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতে পেয়েছি” [মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবাহ]
এখানে তাঁদের বলতে তিনি সম্মানিত সাহাবিদের বুঝিয়েছেন।
প্রসিদ্ধ তাবেঈ হাসান বসরী রহ. বলেন:
" ﻻ ﺑﺄﺱ ﺃﻥ ﺗﻌﻄﻰ ﺍﻟﺪﺭﺍﻫﻢ ﻓﻲ ﺻﺪﻗﺔ ﺍﻟﻔﻄﺮ ".
“দিরহাম দিয়ে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করায় কোনো অসুবিধা নেই” [মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহ]
তারপর উমর ইবনে আব্দুল আজিজ রাষ্ট্রীয়ভাবে মুদ্রা দিয়ে ফিতরা আদায়ের নির্দেশ দেন।
ইমাম আবু হানিফা, ইমাম বুখারি, ইমাম ইবনে তাইমিয়া সহ অসংখ্য বিদ্বান মুদ্রা দিয়ে ফিতরা আদায় বৈধ ফতওয়া দেন। কেউ কেউ মুদ্রা বেশি উপকারী হলে এটা দিয়ে ফিতরা আদায় করা উত্তমও বলেছেন। কেননা, এটা সম্পূর্ণ আপেক্ষিক বিষয়। স্থান-কাল, পাত্র ভেদে মানুষের কল্যাণের দিক বিবেচনা করে ফিতরা দেওয়ার পদ্ধতি নির্ধারণ করতে হবে। আর "মাকাসিদুস শারয়্যিয়াহ"-এর দাবিও এটাই।”
সম্মানিত পাঠক, আমার দৃষ্টিতে সাদাকাতুল ফিতর সম্পর্কে এর চেয়ে ভারসাম্যপূর্ণ আলোচনা আর হতে পারে না। অতএব, সকলের প্রতি বিনীত অনুরোধ থাকবে, এ সমস্ত বিষয় নিয়ে ফিতনা সৃষ্টি করবেন না। ইসলাম কোনো সংকীর্ণ ধর্ম নয় যে খাদ্যের বদলে টাকা দিলে আদায় হবে না। কারণ মানুষ টাকা দিয়ে তো খাদ্যই কিনে।
লুবাব হাসান সাফওয়ান
জাজাকাল্লাহ
উত্তরমুছুনআল্লাহ আপনার ইলেম আমলের মধ্যে বরকত দান করুক আমীন
উত্তরমুছুনসুন্দর আলোচনা ধন্যবাদ
উত্তরমুছুন